Posts Tagged ‘সৈয়দ শামসুল হক’


কি আছে তোমার দ্যাশে? নদী আছে? আছে নাকি ঘর?
ঘরের ভিতরে আছে পরানের নিকটে যে থাকে?
উত্তর সিথানে গাছ, সেই গাছে পাখির কোটর
আছে নাকি? পাখিরা কি মানুষের গলা নিয়া ডাকে?
যখন তোমার দ্যাখা জানা নাই পাবো কি পাবো না,
যখন গাছের তলে এই দেহ দিবে কালঘুম,
যথন ফুরায়া যাবে জীবনের নীল শাড়ি-বোনা
তখন কি তারা সব কয়া দিবে আগাম-নিগুম?
আমার তো দ্যাশ নাই, নদী নাই, ঘর নাই, লোক,
আমার বিছানে নাই সোহাগের তাতের চাদর,
আমার বেড়ায় খালি ইন্দুরের বড় বড় ফোক,
আমার বেবাক ফুল কাফনের ইরানী আতর।
তোমার কি সাধ্য আছে নিয়া যাও এইখান থিকা,
আমার জীবন নিয়া করো তুমি সাতনরী ছিকা।


জামার ভিতর থিকা যাদুমন্ত্রে বারায় ডাহুক,
চুলের ভিতর থিকা আকবর বাদশার মোহর,
মানুষ বেকুব চুপ,হাটবারে সকলে দেখুক
কেমন মোচড় দিয়া টাকা নিয়া যায় বাজিকর ৷
চক্ষের ভিতর থিকা সোহাগের পাখিরে উড়াও,
বুকের ভিতর থিকা পিরীতের পূর্ণিমার চান,
নিজেই তাজ্জব তুমি – একদিকে যাইবার চাও
অথচ আরেক দিকে খুব জোরে দেয় কেউ টান৷
সে তোমার পাওনার এতটুকু পরোয়া করে না,
খেলা যে দেখায় তার দ্যাখানের ইচ্ছায় দেখায়,
ডাহুক উড়ায়া দিয়া তারপর আবার ধরে না,
সোনার মোহর তার পড়া থাকে পথের ধূলায় ৷
এ বড় দারুণ বাজি, তারে কই বড় বাজিকর
যে তার রুমাল নাড়ে পরানের গহীন ভিতর ৷


নষ্ট জলে পা ধুয়েছো এখন উপায় কি?
আচ্ছাদিত বুকের বোঁটা চুমোয় কেটেছি।
কথার কোলে ইচ্ছেগুলো বাৎসায়নের রতি,
মানে এবং অন্য মানে দুটোই জেনেছি।
নষ্ট জলে ধুইয়ে দেবে কখন আমার গা,
তোমার দিকে হাঁটবে কখন আমার দুটো পা?
সেই দিকে মন পড়েই আছে, দিন তো হলো শেষ;
তোমার মধ্যে পবিত্রতার একটি মহাদেশ
এবং এক জলের ধারা দেখতে পেয়েছি-
একেই বুঝি মানুষ বলে, ভালোবেসেছি।


কিছু শব্দ উড়ে যায়, কিছু শব্দ ডানা মুড়ে থাকে,
তরল পারার মতো কিছু শব্দ গলে পড়ে যায়।
এমন সে কোন শব্দ নক্ষত্রের মতো ফুটে থাকে_
তুমি কি দেখেছো তাকে হৃদয়েশ্বরের আয়নায়?
দ্যাখোনি যখন কালো অন্ধকার উঠে আসে_ গ্রাসে।
যখন সৌজন্য যায় কবরে মাটি কল্পতায়,
যখন স্তব্ধতা গিলে খেতে থাকে কামুকেরা ত্রাসে,
তখন তাকিয়ে দেখো শুদ্ধতার গভীর ব্যাথায়_
আমার ঠোঁটের থেকে একটি যে শব্দ একদিন
ফুটেছিলো এই ঠোঁটে তোমারই যে দেহস্পর্শ তাপে,
আজ সেই শব্দ দ্যাখো পৃথিবীর বুকে অন্তরীণ_
তবু তারই উচ্চারণে বৃক্ষপাতা বারবার কাঁপে।
পড়ে নিও তুমি তাকে, দেখে নিও আকাশে নয়তো
সেই শব্দ ‘ভালোবাসি’ নক্ষত্রের মতোই হয়তো।।


আমি জন্মেছি বাংলায়
আমি বাংলায় কথা বলি।
আমি বাংলার আলপথ দিয়ে, হাজার বছর চলি।
চলি পলিমাটি কোমলে আমার চলার চিহ্ন ফেলে।
তেরশত নদী শুধায় আমাকে, কোথা থেকে তুমি এলে ?

আমি তো এসেছি চর্যাপদের অক্ষরগুলো থেকে
আমি তো এসেছি সওদাগরের ডিঙার বহর থেকে।
আমি তো এসেছি কৈবর্তের বিদ্রোহী গ্রাম থেকে
আমি তো এসেছি পালযুগ নামে চিত্রকলার থেকে।

এসেছি বাঙালি পাহাড়পুরের বৌদ্ধবিহার থেকে
এসেছি বাঙালি জোড়বাংলার মন্দির বেদি থেকে।
এসেছি বাঙালি বরেন্দ্রভূমে সোনা মসজিদ থেকে
এসেছি বাঙালি আউল-বাউল মাটির দেউল থেকে।

আমি তো এসেছি সার্বভৌম বারোভূঁইয়ার থেকে
আমি তো এসেছি ‘কমলার দীঘি’ ‘মহুয়ার পালা’ থেকে।
আমি তো এসেছি তিতুমীর আর হাজী শরীয়ত থেকে
আমি তো এসেছি গীতাঞ্জলি ও অগ্নিবীণার থেকে।

এসেছি বাঙালি ক্ষুদিরাম আর সূর্যসেনের থেকে
এসেছি বাঙালি জয়নুল আর অবন ঠাকুর থেকে।
এসেছি বাঙালি রাষ্ট্রভাষার লাল রাজপথ থেকে
এসেছি বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর থেকে।

আমি যে এসেছি জয়বাংলার বজ্রকণ্ঠ থেকে
আমি যে এসেছি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ থেকে।
এসেছি আমার পেছনে হাজার চরণচিহ্ন ফেলে
শুধাও আমাকে ‘এতদূর তুমি কোন প্রেরণায় এলে ?

তবে তুমি বুঝি বাঙালি জাতির ইতিহাস শোনো নাই-
‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’
একসাথে আছি, একসাথে বাঁচি, আজো একসাথে থাকবোই
সব বিভেদের রেখা মুছে দিয়ে সাম্যের ছবি আঁকবোই।

পরিচয়ে আমি বাঙালি, আমার আছে ইতিহাস গর্বের-
কখনোই ভয় করিনাকো আমি উদ্যত কোনো খড়গের।
শত্রুর সাথে লড়াই করেছি, স্বপ্নের সাথে বাস;
অস্ত্রেও শান দিয়েছি যেমন শস্য করেছি চাষ;
একই হাসিমুখে বাজায়েছি বাঁশি, গলায় পরেছি ফাঁস;
আপোষ করিনি কখনোই আমি- এই হ’লো ইতিহাস।

এই ইতিহাস ভুলে যাবো আজ, আমি কি তেমন সন্তান ?
যখন আমার জনকের নাম শেখ মুজিবুর রহমান;
তারই ইতিহাস প্রেরণায় আমি বাংলায় পথ চলি-
চোখে নীলাকাশ, বুকে বিশ্বাস পায়ে উর্বর পলি।


নষ্ট জলে পা ধুয়েছো এখন উপায় কি?
আচ্ছাদিত বুকের বোঁটা চুমোয় কেটেছি।
কথার কোলে ইচ্ছেগুলো বাৎসায়নের রতি,
মানে এবং অন্য মানে দুটোই জেনেছি।
নষ্ট জলে ধুইয়ে দেবে কখন আমার গা,
তোমার দিকে হাঁটবে কখন আমার দুটো পা?
সেই দিকে মন পড়েই আছে, দিন তো হলো শেষ;
তোমার মধ্যে পবিত্রতার একটি মহাদেশ
এবং এক জলের ধারা দেখতে পেয়েছি-
একেই বুঝি মানুষ বলে, ভালোবেসেছি।